পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির একমাত্র হজ্জের ভাষণ (বিদায় হজ্জের ভাষণ) যুগের জ্ঞানের আলোকে অনুবাদ ও শিক্ষা
খ্রিষ্টান গবেষক, চিন্তাবিদ ও লেখক মাইকেল হার্ট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষদের মান বা মর্যাদাভিত্তিক তালিকা করার জন্য ১০০জন বিখ্যাত মানুষের জীবনচরিত নিয়ে গবেষণা করেন। ঐ মানুষগুলোর জীবনের যে সকল দিক নিয়ে তিনি গবেষণা করেন তা হলো- মানব জাতির কল্যাণের বিষয়ে ভূমিকা, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, নারী স্বাধীনতা, আত্মত্যাগ, আচার-আচরণ, স্বজনপ্রীতি, সাম্য, সফলতা, কর্মকাণ্ডের সংরক্ষণ ও প্রচার, অনুসরণকারীদের সংখ্যা ইত্যাদি। অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে মাইকেল হার্ট তার গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। গবেষণা শেষে তিনি লিখতে বাধ্য হন যে- ঐ ১০০জন মানুষের মধ্যে তথা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি হলেন, রাসূল মুহাম্মাদ (স.)।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি তাঁর পালন করা একমাত্র হজ্জে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন সেটি ব্যাপক তথ্যধারণকারী ও মানবতার জন্য ব্যাপক কল্যাণকর। ভাষণটির যে সকল অনুবাদ বর্তমানে উপস্থিত আছে তা যুগের জ্ঞানের আলোকে নয়। আর ভাষণটির যে সকল ভাবার্থ বর্তমানে উপস্থিত সেখানে কিছু মৌলিক ত্রুটিও আছে। তাই, মানবতার কল্যাণের জন্য ভাষণটির যুগের জ্ঞানের আলোকে রচিত এ অনুবাদ ও ভাবার্থ জানা, মানা ও প্রচার করা দরকার।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি মানব জীবন সম্পর্কিত অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলো ভাষণটিতে উল্লেখ করেছেন তা উপস্থাপন করার সময় তিনি হে মুসলিমগণ! বা হে মু’মিনগণ! বলে শ্রোতাদেরকে সম্বোধন করেননি। তিনি সম্বোধন করেছেন, হে মানুষ! বলে। অর্থাৎ ভাষণটি শুধু মুসলিমদের উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়নি। ভাষণটি প্রদান করা হয়েছে পৃথিবীর সকল মানুষকে উদ্দেশ্য করে। ভাষণটির মূল ভাবার্থমূলক বক্তব্যসমূহ হলো-
১. সকল মানুষের আদি পিতা ও মাতা অভিন্ন (আদম আ. ও হাওয়া আ.)। তাই, পৃথিবীর সকল মানুষ জন্মসূত্রে ভাই-বোন (সুতরাং, ভাই-বোনের এ সম্পর্ক অটুট রাখা ও উন্নত করার মাধ্যমে বিশ্বকে শান্তিময় করা মানব সভ্যতার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক দায়িত্ব ও কর্তব্য)।
২. সকল দিন, মাস, শহর ও দেশে মানুষের রক্ত, জীবন, সম্পদ ও মর্যাদা (সকল ধরনের মানবাধিকার) পরষ্পরের জন্য অতি পবিত্র ও নিরাপদ (অতি সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ)।
৩. ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নিষেধ (কারণ, আল্লাহর কিতাবের মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করা হয়েছে। আর কোনো মানুষ নিজ ইচ্ছায় মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে না। আল্লাহই তাদের সেখানে পাঠান)
৪. পিতা মাতার যত্ন নেয়া এবং জন্ম সূত্রে সৃষ্টি হওয়া আপন ভাই-বোন ও আত্মীয়তা এবং বৈবাহিক সূত্রে সৃষ্টি হওয়া আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখা সকলের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ।
৫. জাহিলী যুগের (জন্মগতভাবে আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের উৎস Common Sense /আকল/বিবেকেও কাজে না লাগানো যুগ) সকল বিষয় (বংশ, গায়ের রং, ভাষা, দেশ, শারীরিক গঠন নিয়ে অহংকার, মানুষকে দাস হিসেবে ক্রয় করা, কন্যা সন্তান জীবন্ত কবর দেয়া, নারীদের মানবাধিকারকে অবজ্ঞা করা, বংশের অহংকার, জন্মসূত্রে রাজা/ক্ষমতার মালিক হওয়া, বাক স্বাধীনতা হরণ করা, উলঙ্গভাবে কাবা তাওয়াফ করা ইত্যাদি প্রথা ও অপসংস্কৃতি) আমার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে বাতিল তথা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
৬. জাহিলী যুগের রক্তের সকল দাবিও বাতিল হওয়া।
৭. জাহিলী যুগের সুদও বাতিল হওয়া।
৮. মুসলিমরা একে অপরের ভাই। তাই একের অপরের ওপর কোন ধরনের জুলুম গ্রহনযোগ্য নয়। (এ ভাইের সম্পর্ক হলো- জীবন সম্পর্কিত পরিপূর্ণ বিশ্বাসের সূত্রে। পৃথিবীর সকল মানুষ, আদি পিতা ও মাতা সূত্রে ভাই-বোন। কিন্তু সাধারণ নৈতিকতা তথা Common sense (বিবেক/আকল) সমর্থিত বিষয়ে পৃথিবীর সকল মানুষের বিশ্বাস অভিন্ন হলেও কুরআন ও সুন্নাহ উপস্থাপিত জীবন সম্পর্কিত পরিপূর্ণ বিশ্বাসের দৃষ্টিকোন থেকে পার্থক্য বিদ্যমান। তাই, মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক, মুসলিমদের এবং অমুসলিমদরে মধ্যকার ভাই-বোনের সম্পর্কের তুলনায় অধিক গভীর হওয়া স্বাভাবিক)।
৯. স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহ সচেতন হওয়া (স্বামীদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার ও চাওয়া-পাওয়া এবং স্ত্রীদের ওপর স্বামীদের অধিকার ও চাওয়া-পাওয়া ও শাসনের সীমারেখার বিষয়ে কুরাআন, সুন্নাহ, বিজ্ঞান, সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক সত্য উদাহরণ এবং সাধারণ ও ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ও কাহিনীর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন এবং তা অনুসরণ করা)। স্ত্রীদেরকে স্বামীরা আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর বিধান মোতাবেক স্বামীদের জন্য স্ত্রীদের লজ্জাস্থান হালাল হয়েছে। স্ত্রীদের ওপর স্বামীদেরও অধিকার আছে।
১০.অপরাধের জন্য অপরাধী নিজেই দায়ী। সন্তানের অপরাধ পিতার উপর এবং পিতার অপরাধ সন্তানের উপর বর্তায় না।
১১.রব তথা আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন হওয়া (কুরাআন, সুন্নাহ, বিজ্ঞান, সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক সত্য উদাহরণ এবং সাধারণ ও ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ও কাহিনীর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন এবং তা অনুসরণ করা)।
১২. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, রামাযান মাসের সিয়াম পালন করা, যাকাত আদায় করা (পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার মাধ্যমে সালাতের প্রতিটি অনুষ্ঠান ও পঠিত বিষয় থেকে দিতে চাওয়া শিক্ষা নিয়ে সে শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনে প্রতিষ্ঠা করা, রামাদান মাসের সিয়াম পালন করার মাধ্যমে পেটের ক্ষুধা ও জৈবিক ক্ষুধা উপেক্ষা করে আল্লাহ যা নিষেধ করেছে তা থেকে দূরে থাকা, যাকাত আদায় করার মাধ্যমে সমাজকে দরিদ্রতার কলুষ মুক্ত করা।
১৩. নেতার অনুসরণ কর। আর নেতা হওয়ার যোগ্যতা বংশ, ভাষা, দেশ, গায়ের রং ইত্যাদি নয় বরং তা হলো তাকওয়া তথা আল্লাহ সচেতনতা (কুরাআন, সুন্নাহ, বিজ্ঞান, সাধারণ ও বৈজ্ঞানিক সত্য উদাহরণ এবং সাধারণ ও ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা ও কাহিনীর মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন এবং তা অনুসরণ করা)।
১৪. পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর মুসলমানগণ পরস্পরকে হত্যা করে কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন না করা।
১৫. মৃত্যুর পর সকলকে দুনিয়ার কর্মকাণ্ড এবং আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ব্যবহার করা সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
১৬. কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন ও অনুসরণ করলে পথভ্রষ্ট না হওয়ার নিশ্চয়তা।
১৭. উপস্থিতগণকে অনুপস্থিতদের নিকট তাঁর ভাষণের বক্তব্য পৌঁছে দেয়া। কেননা, অনেক ক্ষেত্রে (বর্তমান বা ভবিষ্যত প্রজন্মের) যাদের নিকট পৌঁছানো হবে তাদের কেউ কেউ উপস্থিতদের চেয়ে বেশি অনুধাবন, ব্যাখ্যা ও সংরক্ষণকারী হবে।
Reviews
There are no reviews yet.